রবিবার ১৯ মে ২০২৪
Online Edition

জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় তত্ত্বাবধায়কের সমাধান?

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল: দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সরকার বিরোধীদের আলোচনার মধ্যস্থতাকারী হিসেবে শোনা যাচ্ছে জাতিসংঘের নাম। আর আলোচনা নিয়ে এই সম্ভাবনার কথাটি এসেছে খোদ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমুর কাছ থেকে। গত ৬ জুন রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে ১৪ দলের জনসভায় তিনি বলেছেন, প্রয়োজনে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় বিএনপির সঙ্গে আলোচনা হতে পারে। প্রথম দিকে তার বক্তব্যটি একান্তই ব্যক্তিগত বলে প্রচার করা হলেও সম্প্রতি সরকারি দলের শীর্ষ নেতাদের কথায় এটি যে ক্ষমতাসীন জোটের বক্তব্য হিসেবেই বুঝা যাচ্ছে। তবে জাতিসংঘের পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ দাতা সংস্থাগুলো দেশের রাজনীতি নিয়ে সোচ্চার। তারা বিভিন্ন রাজনীতিক দলের সাথে সিরিজ বৈঠক করছেন। এসব বৈঠক থেকে তারা বাংলাদেশে সবার অংশগ্রহণে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনেরই তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন। 

সূত্র মতে, দেশের রাজনীতিতে বিদেশীদের হস্তক্ষেপ নতুন কিছু নয়। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে এবং ১৯৯৬ সালে সংবিধানে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান যুক্ত করার আন্দোলনের সময়েও বিদেশী মধ্যস্থতা হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখেও বিদেশী কূটনীতিকদের তৎপরতা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি এবং সংকট সমাধানে জাতিসংঘের মধ্যস্থতার খবর আসছে। তাতেও শেষ মেষ দেশের প্রধান দুই জোটের মধ্যে কোনো ঐক্য হবে কি না সেটি বিরাট প্রশ্ন রয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলগুলো অবস্থান নিয়েছিল। তখন জাতিসংঘ মহাসচিবের দূত হিসেবে সংলাপের তাগিদ দিতে বাংলাদেশে এসেছিলেন অস্কার ফার্নান্দেজ-তারানকো। তিনি প্রধান দুটি দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনাও করেন। এমনকি তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গেও বৈঠক করেন। এছাড়াও তারানকো জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বৈঠক করেন। কিন্তু বিরোধীদের প্রধান দাবি ছিল প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ, সেটি ক্ষমতাসীনরা মানতে রাজি হয়নি। নির্বাচনের আগে ছোট পরিসরে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছিল। তখন বিএনপি সংসদে থাকলেও তারা এই সরকারে তাদের কোনো প্রতিনিধি দেয়নি। এমনকি তারা ওই নির্বাচন বয়কট করে। তার মানে সংকট সমাধানে বিদেশী মধ্যস্থতা বা দূতিয়ালি কোনো কাজে আসেনি। 

এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে চুরানব্বই, পঁচানব্বই ও ছিয়ানব্বই সালের আন্দোলনে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী অভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। এই ইস্যুতে রাজনৈতিক সংকট নিরসনে তথা সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতার জন্য তখন কমওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান স্টিফেন ১৯৯৪ সালের ১৩ অক্টোবর ঢাকায় আসেন। তিনি প্রায় মাসব্যাপী উভয় দলের নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় সংলাপ করেন। সংলাপের এক পর্যায়ে তিনি একটি ফর্মুলা দেন। স্যার নিনিয়ানের এই প্রস্তাবে ক্ষমতাসীন বিএনপি সম্মতি জানালেও বিরোধী দল সেটি মানতে রাজি হয়নি। বরং তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া অন্য কোনো ফর্মুলা মানবে না বলে জানিয়ে দেয়। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে সমঝোতার ওই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যায়।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের রাজনীতির যে চরিত্র এবং দলগুলোর মধ্যে যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও অনাস্থা, তার কারণেই বাইরের হস্তক্ষেপ বা সংলাপে বড় কোনো সমস্যার সমাধান হয় না। বরং আন্দোলনের মাঠ যাদের দখলে থাকে, ভোটের ফলাফলও আসে তাদের ঘরে। ফলে এখন যে প্রশ্নটি সামনে আসছে তা হলো, যদি শেষমেষ জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং মাঠের রাজনীতিতে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির মধ্যে বৈঠক হয়ও, তাতেও সমস্যার সমাধান হবে কি না? কেননা, বিএনপির দাবি সরকারের পদত্যাগ এবং একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। যেটির প্রধান হবেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য কেউ। এ দুটি দাবি মানতে গেলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। তারা বলছেন, যে পরিস্থিতিতে ১৯৯৬ সালে সংবিধান সংশোধন করে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান যুক্ত করা হয়েছিল, সেই পরিস্থিতি কি এ মুহূর্তে দেশে বিদ্যমান রয়েছে কিংবা সেরকম বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে তোলার মতো সক্ষমতা বিএনপির আছে? কিংবা সরকারের ওপর কি এমন কোনো চাপ আছে যার কারণে তারা বিদেশীদের মধ্যস্থতায় এমন কোনো দাবি মেনে নেবে। যার ফলে তাদের পুনরায় সরকার গঠন করা অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে? নাকি অন্য কিছু ঘটবে? 

আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আমির হোসেন আমু বলেছেন, প্রয়োজনে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় তারা বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় বসতে চান। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি আসুক। আমরা বিএনপির সঙ্গে মুখোমুখি বসে দেখতে চাই, কোথায় সমস্যা, সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা কোথায় এবং কীভাবে সেটা নিরসন করা যায়। এটা আলোচনার মধ্য দিয়েই সুরাহা হতে পারে, অন্য কোন পথে নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বীর আহমেদ বলেন, এখনকার পরিস্থিতি জাতিসংঘের আবার বিশেষ দূতের আলোচনায় আসার মতো সম্ভাবনা তিনি দেখছেন না। এগুলো আসলে বিরোধী দলকে বিভ্রান্ত করতে নানারকম বার্তা দেয়া হচ্ছে। তাদের আসল উদ্দেশ্য হলো,  বিএনপি ছাড়া সব দলকে নিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করা। সেখানে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় আসলে তো তেমন কিছু হয় না। জাতিসংঘ তো ২০১৪ নির্বাচনের আগেও মধ্যস্থতা করেছে, তাতে কি কোন পরিবর্তন এসেছিল?

সূত্র মতে, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে শেষ করতে কোনো রাজনৈতিক দলই দৃশ্যত জাতিসংঘের কাছে সহায়তা চায়নি। তবে জাতিসংঘ ‘স্বপ্রণোদিত’ হয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে চেয়েছে। জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস জানিয়েছেন, বাংলাদেশ সরকার চাইলে আগামী সংসদ নির্বাচনে তারা সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত আছে। সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে এ প্রস্তাব দেন গোয়েন লুইস। জানা গেছে, জাতিসংঘ কোনো দেশের জাতীয় নির্বাচনে পরামর্শ, কারিগরি, লজিস্টিক, প্রশিক্ষণ, ভোটার তালিকা প্রণয়ন, নির্বাচনের বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টিসহ প্রভৃতি সহায়তা করে থাকে। সংস্থাটি ইতোমধ্যে শতাধিক রাষ্ট্রকে নির্বাচনী সহায়তা দিয়েছে। এ কাজগুলো জাতিসংঘ সরাসরি করা ছাড়াও এর অঙ্গ ও বিশেষায়িত সংস্থাগুলোও করে থাকে। জাতিসংঘ অনেক সময় নির্বাচন পর্ববেক্ষকের ভূমিকাও পালন করে। এ ছাড়া নির্বাচনে বিদেশী পর্যবেক্ষকদের সমন্বয়ের কাজও করে থাকে সংস্থাটি। 

এদিকে জাতিসংঘের পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে সোচ্চার। তারই অংশ হিসেবে নির্বাচন বিষয়ক ৬ সদস্যের তথ্যানুসন্ধানী মিশন ১৬ দিনের সফরে ঢাকা আসছে। এদের মধ্যে দুজন গত শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকায় পৌঁছেছেন। বাকি ৪ জন গতকাল রোববার এসেছে। তাদের সঙ্গে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামীসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সবার সাথে বৈঠক হবার কথা রয়েছে। এছাড়া এ সপ্তাহে ঢাকায় আসছে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী একটি প্রতিনিধি দল। ইইউ দূতাবাসের একটি সূত্রে জানা গেছে, এ প্রতিনিধিদলের মূল কাজ হবে ইইউর পর্যবেক্ষকদের কর্মপরিধি, পরিকল্পনা, তাদের জন্য বাজেট, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, নিরাপত্তা ইত্যাদি মূল্যায়ন করা। এ ছাড়া তারা সরকারের প্রতিনিধি, নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা এবং সুশীলসমাজ ও গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এর পর ব্রাসেলস ফিরে গিয়ে তারা এ বিষয়ে প্রতিবেদন দেবেন।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি না মানলে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ। তিনি বলেন, ১০ দফা না মানলে শেখ হাসিনার পতনের এক দফা আন্দোলন শুরু হবে। দেশের মানুষ ছাড়া বন্ধু রাষ্ট্রগুলোও চায় বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হোক। সেজন্য বিদেশি কূটনীতিকরা বাংলাদেশে আসছেন, সরকারকে সুষ্ঠু নির্বাচনের তাগিদ দিচ্ছেন। তিনি বলেন, ক্ষমতাসীনরা যদি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি না মানে তাহলে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে নির্বাচন হতে পারে- এমন সম্ভাবনাও রয়েছে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গণমাধ্যমে বলেছেন, নিজেদের সমস্যা নিয়ে আমরা আলোচনা করব। প্রয়োজন হলে নিজেরাই সমাধান করব। এখানে জাতিসংঘের মধ্যস্থতা বা হস্তক্ষেপের প্রয়োজন আছে, এমন রাজনৈতিক সংকট দেশে তৈরি হয়নি।

জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, কোনো দেশের রাজনৈতিক সমঝোতার প্রচেষ্টায় প্রথমেই বিভিন্ন পক্ষের বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়। বাংলাদেশের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে তাই বিরোধীদের কাছে জানতে চাওয়া হতে পারে তারা সর্বনিম্ন কি শর্তে নির্বাচনে যাবে। অপরদিকে সরকারের কাছে জানতে চাইবে সর্বোচ্চ কতটুকু ছাড় তারা দিতে পারে। এরপর চলবে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সমঝোতার।  

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ